,

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি: স্থানীয়রা আতংকিত

শাকুর মাহমুদ চৌধুরী, কক্সবাজারঃ

কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধের মাত্রা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই নানা ধরণের সহিংস ঘটনা, মাদক ব্যবসা, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি ও স্বর্ণ চোরাচালানের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনগণ তাদের জীবনযাপন নিয়ে চরমভাবে উদ্বিগ্ন এবং নিরাপত্তার অভাবে আতঙ্কিত। উখিয়া ও টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় অপরাধের পরিধি দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে, যা পুরো অঞ্চলের শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করছে।

ক্যাম্পগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাদক ব্যবসা এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়ছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসা এবং মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও আশেপাশে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র, যারা এসব অপরাধ পরিচালনা করছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আশেপাশে একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত কয়েক মাসে উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় খুন এবং সহিংস হামলার মতো ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন যে, এসব অপরাধীদের অনেকেই বহিরাগত এবং শিবিরের অভ্যন্তর থেকেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

মাদকদ্রব্য পাচার এবং চোরাচালানের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। বিশেষ করে, ইয়াবার অবৈধ ব্যবসা কক্সবাজার এবং এর আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন তথ্যমতে, শিবিরে থাকা অপরাধীরা ইয়াবার চালান মিয়ানমার থেকে নিয়ে এসে এই ব্যবসা পরিচালনা করছে। এটি শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং যুবসমাজকেও নেশাগ্রস্ত করে তুলছে।

তাছাড়া, স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনাও রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বর্ণ পাচারের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান সম্পদ, যা চোরাচালানিদের হাতে গিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

ক্যাম্পগুলোতে নারীদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ঘটেছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব অপরাধে রোহিঙ্গা যুবকরা জড়িত। নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকেই নিজেদের ঘরের বাইরে যেতেও ভয় পাচ্ছে।

স্থানীয় নারীদের মধ্যে সামিরা আকতার বলেন, প্রতিদিন খবর পাই কোথাও না কোথাও নারীদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। রাতে বাইরে বের হওয়া তো দূরের কথা, দিনের বেলাতেও অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

অপরাধের ঊর্ধ্বগতি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের জীবনকেই বিপর্যস্ত করছে না, বরং স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। চুরি, ডাকাতি এবং হুমকির কারণে ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশেপাশের বাজারগুলোর ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত, কারণ তারা প্রতিনিয়ত নানা অপরাধমূলক ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী কপিল উদ্দিন বলেন, আমাদের ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন চুরি আর ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। আমরা চাই প্রশাসন আরও কঠোর পদক্ষেপ নিক, নাহলে আমরা বাঁচতে পারব না।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে অপরাধ দমনে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে স্থানীয়দের মতে, এই পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা, ক্যাম্পে নিয়মিত টহল জোরদার করা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। অনেকেই মনে করছেন, অপরাধ দমনে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন, যেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে থাকা অপরাধীদের সনাক্ত করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্থানীয় এক সমাজসেবী জাহেদ আলম জানান, প্রশাসন যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। ক্যাম্পে যারা অপরাধ করছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যাম্পগুলোতে অপরাধের মাত্রা কমাতে হলে প্রশাসনকে বিশেষ কৌশল গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র বাহিনী বৃদ্ধি করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, বরং ক্যাম্পের ভেতরে এবং বাইরে নিয়মিত টহল এবং নজরদারি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়া, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা অপরাধ চক্র গুলোকে ভেঙে দিতে হবে।

একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরে নানা ধরণের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্যাম্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও মজবুত করতে হবে। অন্যথায়, এই সমস্যা আরও বাড়বে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ প্রবণতার এই ঊর্ধ্বগতি পুরো এলাকার শান্তি ও শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত করছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোর এবং সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর একসাথে কাজ করতে হবে যেন দ্রুত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং উখিয়া ও টেকনাফের জনগণের মাঝে আবারও নিরাপত্তা ফিরে আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category